কাঁকণমালা, কাঞ্চনমালা

 কাঁকণমালা, কাঞ্চনমালা

শ্রীদক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার


এক রাজপুত্র আর এক রাখাল, দুই জনে বন্ধু। রাজপুত্র প্রতিজ্ঞা করিলেন, যখন তিনি রাজা হইবেন, রাখাল বন্ধুকে তাঁহার মন্ত্রী করিবেন।
রাখাল বলিল,-"আচ্ছা।"
দুইজনে মনের সুখে থাকেন। রাখাল মাঠে গরু চরাইয়া আসে, দুই বন্ধুতে গলাগলি হইয়া গাছতলে বসেন। রাখাল বাঁশী বাজায়, রাজপুত্র শোনেন। এইরূপে দিন যায়।
banner
রাজপুত্র রাজা হইলেন। রাজা রাজপুত্রের কাঞ্চনমালা রাণী, ভাণ্ডার ভরা মাণিক, কোথাকার রাখাল,—সে আবার বন্ধু! রাজ-পুত্রের রাখালের কথা মনেই রহিল না।
একদিন রাখাল আসিয়া রাজদুয়ারে ধর্ণা দিল—"বন্ধুর রাণী কেমন, দেখাইল না।" দুয়ারী তাঁহাকে "দূর, দূর” করিয়া খেদাইয়া দিল। মনের কষ্টে রাখাল কোথায় গেল, কেহই জানিল না।
পরদিন ঘুম হইতে উঠিয়া রাজা চোক মেলিতে পারেন না। কি হইল, কি হইল?—রাণী দেখেন, সকলে দেখে, রাজার মুখ-ময় সূচ, গা-ময় সূচ, মাথার চুল পর্যন্ত সূচ হইয়া গিয়াছে।—এ কি হইল! রাজপুরীতে কান্নাকাটি পড়িল। রাজা খাইতে পারেন না, শুইতে পারেন না, কথা কহিতে পারেন না। রাজা মনে মনে বুঝিলেন, রাখাল-বন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়া প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গিয়াছি, সেই পাপে এ-দশা হইল। কিন্তু মনের কথা কাহাকেও বলিতে পারেন না।
সূ'চরাজার রাজসংসার অচল হইল, —সূচরাজা মনের দুঃখে মাথা নামাইয়া বসিয়া থাকেন; রাণী কাঞ্চনমালা দুঃখে কষ্টে কোন রকমে রাজত্ব চালাইতে লাগিলেন।
banner
একদিন রাণী নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়াছেন, কাহার এক পরমাসুন্দরী মেয়ে আসিয়া বলিল,—"রাণী যদি দাসী কিনেন, তো, আমি দাসী হইব।” রাণী বলিলেন—"সূচরাজার সূচ খুলিয়া দিতে পার তো আমি দাসী কিনি।"
দাসী স্বীকার করিল।
তখন রাণী, হাতের কাঁকন দিয়া দাসী কিনিলেন।
দাসী বলিল,—"রাণী মা, তুমি বড় কাহিল হইয়াছ; কতদিন না-জানি ভাল করিয়া খাও না, নাও না। গায়ের গহনা ঢিলা হইয়াছে, মাথার চুল জটা দিয়াছে। তুমি গহনা খুলিয়া রাখ, বেশ করিয়া ক্ষার-খৈল দিয়া স্নান করাইয়া দেই।"
রাণী বলিলেন,—"না মা, কি আর স্নান করিব, —থাক।"
দাসী তাহা শুনিল না। রাণীর গায়ের গহনা খুলিয়া ক্ষার-খৈল মাখাইয়া দিল। দিয়া বলিল,—"মা, এখন ডুব দাও।"
রাণী গলা-জলে নামিয়া ডুব দিলেন। দাসী চক্ষের পলকে রাণীর কাপড় পরিয়া, রাণীর গহনা গায়ে দিয়া ঘাটের উপর উঠিয়া ডাকিল—
"দাসী লো দাসী পান-কৌ।
ঘাটের উপর রাজা বৌ!
রাজার রাণী কাঁকণমালা;
—ডুব দিবি আর কত বেলা?"
রাণী ডুব দিয়া উঠিয়া দেখেন, দাসী রাণী হইয়াছে, তিনি বাঁদী হইয়াছেন। রাণী কপালে চড় মারিয়া, ভিজা চুলে কাঁপিতে কাঁপিতে কাঁকণমালার সঙ্গে চলিলেন।
banner
রাজপুরীতে গিয়া কাঁকণমালা পুরী মাথায় করিল। মন্ত্রীকে বলে, —"আমি নাইয়া আসিতেছি, হাতী ঘোড়া সাজাও নাই কেন?" পাত্রকে বলে,—"আমি নাইয়া আসিব, দোল-চৌদোলা পাঠাও নাই কেন?” মন্ত্রীর, পাত্রের, গর্দান গেল।
সকলে চমকিল, এ আবার কি! —ভয়ে কেহ কিছু বলিতে পারিল না। কাঁকণমালা রাণী হইয়া বসিল, কাঞ্চনমালা দাসী হইয়া রহিলেন! রাজা কিছুই জানিতে পারিলেন না।
কাঞ্চনমালা আঁস্তাকুড়ে বসিয়া মাছ কোটেন আর কাঁদেন,—
"হাতের কাঁকণ দিয়া কিনলাম দাসী।
সেই হইল রাণী, আমি হইলাম বাঁদী।
কি বা পাপে সোণার রাজার রাজ্য গেল ছার
কি বা পাপে ভাঙ্গিল কপাল কাঞ্চনমালার?"
রাণী কাঁদেন আর চোকের জলে ভাসেন।
রাজার কষ্টের সীমা নাই। গায়ে মাছি ভিভিন্, সূচের জ্বালায় গা-মুখ চিচিন্, কে বাতাস করে, কে বা ওষুধ দেয়!
banner
একদিন ক্ষার-কাপড় ধুইতে কাঞ্চনমালা নদীর ঘাটে গিয়াছেন। দেখেন, একজন মানুষ একরাশ সূতা লইয়া গাছতলায় বসিয়া বসিয়া বলিতেছে,—
"পাই এক হাজার সূচ
তবে খাই তরমুজ!
সূচ পেতাম পাঁচ হাজার,
তবে যেতাম হাট-বাজার!
যদি পাই লাখ—
তবে দেই রাজ্যপাট!!"
রাণী, শুনিয়া, আস্তে আস্তে গিয়া বলিলেন, “কে বাছা সূচ চাও, আমি দিতে পারি! তা সূচ কি তুমি তুলিতে পারিবে?"
শুনিয়া, মানুষটা চুপ-চাপ সূতার পুঁটুলি তুলিয়া রাণীর সঙ্গে চলিল।
পথে যাইতে যাইতে কাঞ্চনমালা, মানুষটির কাছে আপনার দুঃখের কথা সব বলিলেন। শুনিয়া, মানুষ বলিল,—"আচ্ছা!"
রাজপুরীতে গিয়া মানুষ রাণীকে বলিল,—"রাণীমা, রাণীমা, আজ পিট-কুণ্ডুলির ব্রত, রাজ্যে পিটা বিলাইতে হয়। আমি লালসূতা নীল-সুতা রাঙাইয়া দি, আপনি গে' আঙ্গিনায় আল্পনা দিয়া পিড়ী সাজাইয়া দেন; ও দাসী-মানুষ যোগাড়-যাগাড় দিক?"
রাণী আহ্লাদে আটখানা হইয়া বলিলেন,—“তা' কেন, হইল-হুইল দাসী, দাসীও আজ পিটা করুক।” তখন রাণী আর দাসী দুইজনেই পিটা করিতে গেলেন।
ও মা! রাণী যে, পিটা করিলেন, আস্কে পিটা, চাস্কে পিটা আর ঘাস্কে পিটা! দাসী, চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশী, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা এই সব পিটা করিয়াছেন।
মানুষ বুঝিল যে, কে রাণী আর কে দাসী।
পিটে-সিটে করিয়া, দুইজনে আল্পনা দিতে গেলেন। রাণী, একমন চা'ল বাটিয়া সাত কলস জলে গুলিয়া এ-ই এক গোছা শনের নুড়ি ডুবাইয়া, সারা আঙ্গিনা লেপিতে বসিলেন। এখানে এক খাবল দেন, ওখানে এক খাবল দেন।
দাসী, আঙ্গিনার এক কোণে একটু ঝা'ড়-ঝুড দিয়া পরিষ্কার করিয়া একটুকু চা'লের গুঁড়ায় খানিকটা জল মিশাইয়া, এতটুকু নেকড়া ভিজাইয়া, আস্তে আস্তে, পদ্ম-লতা আঁকিলেন, পদ্ম-লতার পাশে সোণার সাত কলস আঁকিলেন; কলসের উপর চূড়া, দুই দিকে ধানের ছড়া আকিয়া, ময়ূর, পুতুল, মা লক্ষ্মীর সোণা-পায়ের দাগ, এই সব আঁকিয়া দিলেন।
তখন মানুষ কাঁকণমালাকে ডাকিয়া বলিল,—"ও বাঁদি! এই মুখে রাণী হইয়াছিস?
হাতের কাঁফণের নাগন্ দাসী!
সেই হইল রাণী, রাণী হইলেন দাসী!
ভাল চাহিস তো, স্বরূপ কথা-ক'।"
কাঁকণমালার গায়ে আগুনে হল্কা পড়িল। কাঁকণমালা গর্জিয়া উঠিয়া বলিল,—“কে রে পোড়ারমুখো দূর হ'বি তো হ'।" জল্লাদকে ডাকিয়া বলিল, "দাসীর আর ঐ নির্ব্বংশে'র গর্দান নেও। ওদের রক্ত দিয়া আমি স্নান করিব, তবে আমার নাম কাঁকণমালা।"
জল্লাদ গিয়া দাসী আর মানুষকে ধরিল। তখন মানুষটা পুঁটলী খুলিয়া বলিল,—
"সূতন সূতন নটি!
রাজার রাজ্যে ঘটমটি
সূতন্ সূতন নেবোর পো,
জল্লাদকে বেঁধে থো।"
এক গোছা সূতা গিয়া জল্লাদকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধিয়া থুইল। মানুষটা আবার বলিল, "সূতম্ তুমি কা'র?"—
সূতা বলিল, "পু'টলী যা'র তার।"
মানুষ বলিল,—
"যদি সূতন্ আমার খাও।
কাঁকণমালার নাকে যাও।
banner
সূতোর দুই গুটি গিয়া কাঁকণমালার নাকে ঢিবি হইয়া বসিল। কাঁকণমালা ব্যস্তে-মস্তে ঘরে উঠিয়া বলিতে লাগিল, "দুয়ার দাঁও, দু'য়ার দাঁও, এটা পাঁগল, দাসী পাঁগল নিয়া আসিয়াছে।"
পাগল তখন মন্ত্র পড়িতেছে—
"সূতন্ সূতন্ সরুলি, কোন্ দেশে ঘর?
সূচ-রাজার সূচে গিয়ে আপনি পর্।"
দেখিতে-না-দেখিতে হিল্ হিল্ করিয়া লাখ সূতা রাজার গায়ের লাখ সূঁচে পরিয়া গেল।
তখন সূ'চেরা বলিল,—
"সূতার পরাণ সীলি সীলি, কোন্ ফুড়ণ দি।"
মানুষ বলিল,—
"নাগন্ দাসী কাঁকণমালার চোখ-মুখটি।"
রাজার গায়ের লাখ সূঁচ উঠিয়া গেল, লাখ সূঁচে কাঁকণ-মালার চোখ-মুখ সিলাই করিয়া রহিল। কাঁকণমালার যে ছটফটি।
রাজা চক্ষু চাহিয়া দেখেন,—রাখাল বন্ধু!
রাজায় রাখালে কোলাকুলি করিলেন। রাজার চোকের জলে রাখাল ভাসিল, রাখালের চোকের জলে রাজা ভাসিলেন।
রাজা বলিলেন,—"বন্ধু, আমার দোষ নিও না, শত জন্ম তপস্যা করিয়াও তোমার মত বন্ধু পাইব না। আজ হইতে তুমি আমার মন্ত্রী। তোমাকে ছাড়িয়া আমি কত কষ্ট পাইলাম; আর ছাড়িব না।"
রাখাল বলিল,—"আচ্ছা! তা তোমার সেই বাঁশীটি যে হারাইয়া ফেলিয়াছি; একটি বাঁশী দিতে হইবে!"
রাজা রাখাল-বন্ধুকে সোণার বাঁশী তৈয়ারী করাইয়া দিলেন।
তাহার পর সূচের জ্বালায় দিন-রাত ছটফট করিয়া কাঁকণমালা মরিয়া গেল! কাঞ্চনমালার দুঃখ ঘুচিল।
তখন, রাখাল, সারাদিন মন্ত্রীর কাজ করেন, রাত্রে চাঁদের আলোতে আকাশ ভরিয়া গেলে, রাজাকে লইয়া গিয়া নদীর ধারে সেই গাছের তলায় বসিয়া সোণার বাঁশী বাজান। রাজা গলাগলি করিয়া মন্ত্রী-বন্ধুর বাঁশী শোনেন।
রাজা, রাখাল, আর কাঞ্চনমালার সুখে দিন যাইতে লাগিল।
banner
All reactions:
270

Post a Comment

Previous Post Next Post